বাংলার আয়না

আয়নায় কি প্রাণীদের মনোজগতের প্রকাশ সম্ভব?

ড্যানিয়েল পভিনেলি তখনো হাই স্কুলের শিক্ষার্থী। ওই সময়ই ১৯৭০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণামূলক পরীক্ষার বিষয়ে পড়ে তিনি প্রথম জানতে পারেন, শিম্পাঞ্জিরা নিজেদের আয়নাতে চিনতে পারে।

তিনি স্মরণ করেন, ‘আমি আয়নায় নিজেকে চেনার এ গল্প সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। কেননা এটি আকর্ষণীয় গল্প ছিলো।’

এরজন্য শুধু একটি সাধারণ আয়না প্রয়োজন। এ গল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, আমাদের কাছাকাছি শিম্পাঞ্জি আত্মীয়রা একইরকম আত্মসচেতন। মানুষের মতোই তাদের মধ্যে মৌলিক আত্মধারণা কাজ করে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লুজিয়ানা রাজ্যের লাফিয়েট শহরের ইউনিভার্সিটি অব লুজিয়ানায় কর্মরত বিজ্ঞানী প্রফেসর পভিনেলি স্মরণ করেন, ‘অন্যান্য প্রাণীর মানসিক জগৎ, আত্ম-সচেতনতায় আয়নার কৌশলের মাধ্যমেই শুধু আমাদের প্রবেশ করতে পারার ক্ষমতার এই ধারণা কোনো একভাবে গভীরভাবে প্রলুব্ধকর ছিলো।’

বছরের পর বছর তিনি আয়না ও উচ্চতর সচেতনতার বিষয়ে গবেষণায় তার জীবন কাটিয়েছেন। ফলস্বরূপ নিজেদের প্রতিবিম্ব নিয়ে প্রাণীদের আচরণ সম্পর্কে তার মাঝে বর্তমানে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কৈশোরে তাকে আকর্ষণ করা গল্পেই অর্ধ শতাব্দী পরে এসেও মানুষ আটকে আছে।

পভিনেলি বলেন, ‘যদি আমাকে কোনো সংবাদ প্রতিবেদক এক ডলারের বিনিময়ে গত ৩০ বছরে আয়না, শিম্পাঞ্জি, বানর বা অন্যকিছু সম্পর্কে এমন গল্পের জন্য অনুরোধ করতেন, তবে এতদিনে আমার লাখ ডলার আয় হতো।’

আয়নায় নিজেকে চেনার এই জনপ্রিয় পরীক্ষাটি ১৯৬০ সালে গর্ডন গ্যালপ জুনিয়র প্রথম কল্পনা করেন। বর্তমানে নিউইয়র্ক রাজ্যের আলবেনির স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক কর্মরত এই বিজ্ঞানী তখন গ্রাজুয়েশন শিক্ষার্থী ছিলেন। মনোবিজ্ঞানের ওপর একটি কোর্সের অধ্যায়নের অংশ হিসেবে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টে পরীক্ষার নতুন ধারণা হিসেবে তিনি ওই বিষয়টি উপস্থাপন করেন।

গ্যালপ বলেন, ‘পরীক্ষার নতুন ধারণা উপস্থাপনের বিষয়ে চিন্তা করতে করতে একদিন আমি আয়নার সামনে শেভ করছিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করতে করতে হঠাৎ আমার মনে হলো, আয়নায় অন্যান্য প্রাণীরা যদি নিজেদের চিনতে পারে, তবে তা আকর্ষণীয় নয় কি?’

শেভ করতে করতেই তিনি চিন্তা করেন, তিনি গোপনে একটি প্রাণীর মুখে তার অনুভব না করার মতো লাল রঙের চিহ্ন এঁকে এ পরীক্ষা করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে দেখতে চেয়েছি, এটি আয়না ব্যবহার করতে পারে কিনা এবং অদ্ভুত লাল চিহ্ন সম্পর্কে কোনো কৌতুহল দেখায় কিনা।’

এর আগে এমন কোনো পরীক্ষাই হয়নি। যদিও মানুষ বহু আগে থেকেই আয়নায় প্রাণীদের প্রতিক্রিয়া দেখে আসছিলো।

গ্যালপ জানান, বেশিরভাগ প্রাণীই নিজেদের আয়নার প্রতিবিম্বের সাথে অপরিচিত অন্য একটি প্রাণীর মতো আচরণ করে, যার সাথে বন্ধুত্বের জন্য তারা আগায় বা শত্রুর মতো আক্রমণ করে। তিনি বলেন, ‘প্যারাকিট (বিশেষ প্রজাতির টিয়া পাখি) আয়নায় তাদের প্রতিবিম্বের সাথে এমনভাবে আচরণ করে যেনো তারা তাদের সারাজীবনে প্রথমবারের মতো নতুন একটি প্যারাকিটকে দেখছে।’

কোনো কোনো বিজ্ঞানী ধারণা করতেন প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণীদের আচরণ এক্ষেত্রে সন্তোষজনক হতে পারে। এমনকি চার্লস ডারউইন একবার জেনি নামের এক বন্দি ওরাংওটানের আয়নায় নিজেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার ঘটনা দেখে মুগ্ধ হন।

যখন গ্যালপ সত্যিকার অর্থেই কয়েক বছর পর শিম্পাজি নিয়ে তার পরীক্ষা শুরু করেন, তিনি লক্ষ্য করেন প্রাথমিকভাবে শিম্পাঞ্জিরা আয়নায় তাদের প্রতিবিম্বকে অন্য একটি প্রাণী মনে করছে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই, তাদের আচরণ পরিবর্তন হয়। এসময় তারা তাদের দাঁত, জননাঙ্গসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ আয়নার সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে।

পরে গ্যালপ যখন তাদের অজ্ঞান করে তাদের মুখে লাল রঙ মাখিয়ে দেন, জ্ঞান ফেরার পর তারা নিজেদের আয়নার প্রতিবিম্বে এমন প্রতিক্রিয়া দেখায় যে, তারা যেনো বুঝতে পারে তাদের নিজেদের মুখেই কিছু আছে।

গ্যালপ ব্যাখ্যা করেন, ‘তারা নিজের মুখে এই চিহ্ন হাত দিয়ে অনুভবের মাধ্যমে সন্ধানের চেষ্টা করে যা শুধু আয়নাতেই দেখা যাচ্ছিল।’

তার পরীক্ষার ফলাফল এক সংবেদনশীলতা তৈরি করে। গ্যালপ বলেন, ‘এর গভীর এক প্রভাব ছিলো। আমার প্রত্যাশার থেকেও গভীরতর প্রভাব।’

পরের দশকগুলোতে গবেষকরা তার আয়নায় নিজেকে চেনার এই পরীক্ষা বা এর থেকে সামান্য ভিন্নতর পরীক্ষা নিয়ে কাজ করেন। ম্যাগপাই পাখি থেকে পিঁপড়া, মান্তা রে মাছ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণীর ওপর তারা এই পরীক্ষা চালান।

গ্যালপের মতে, প্রাণীদের মধ্যে মাত্র তিনটি প্রজাতি আয়নায় নিজেকে চিনতে পারে; শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটান এবং মানুষ।

অন্য অনেকেই অবশ্য ধারণা করছেন, এই তালিকা আরো দীর্ঘ। হান্টার কলেজে কর্মরত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী জীববিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ও কগনেটিভ মনোবিজ্ঞানী ডায়ানা রিস ডলফিন ও হাতিকে নিয়ে এ পরীক্ষা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দু’টি প্রাণীই আয়নায় নিজেকে চেনার চিহ্ন দেখিয়েছে।

একটি পরীক্ষায় তার দল ডলফিনের শরীরে চিহ্ন এঁকে দেয়। ডলফিনটি তার শরীরে চিহ্ন আঁকার বিষয় উপলব্ধি করতে পারে কিন্তু তা দেখতে পারেনি। রিস ব্যাখ্যা করেন, ‘পরীক্ষার ধারণা ছিলো তারা কি এর পরপরই আয়নায় গিয়ে চিহ্ন দেয়ার জায়গাটি প্রত্যক্ষণ করে কি?’ তিনি জানান, ‘এবং এই বিষয়টিই আমরা পরীক্ষায় দেখতে পাই।’

তিনি জানান, সাধারণভাবে প্রাণীরা ভিন্নতর আচরণের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায় যখন তারা প্রথম আয়নার মুখোমুখি হয়। প্রাথমিকভাবে, তারা চিন্তা করে আয়নার প্রতিবিম্ব বুঝি অপর একটি প্রাণী। এরপর তারা আয়নার পেছনে বা নিচে পর্যবেক্ষণ করে। এই পর্যায়ের পর, কিছু প্রাণী পুনরাবৃত্তি ও অস্বাভাবিক আচরণের মাধ্যমে আয়না পরীক্ষণ শুরু করে।

রিস বলেন, ‘আমার মনে হয় তখনই তারা বিষয়টি অনুধাবন শুরু করে।’ যখন প্রাণীরা বুঝতে পারে তাদের শরীরের গতিবিধির সাথে সাথে আয়নাতেও গতিবিধিতে পরিবর্তন হচ্ছে, তারা তখন আত্মচালিত আচরণ শুরু করে। এসময় তারা আয়নাকে তাদের নিরীক্ষণের জন্য একটি সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।

তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার সর্বশেষ পর্যায় আয়নায় তাদের নিজেদের চেনার সক্ষমতার প্রমাণ।’ গ্যালপের পরীক্ষা এ বিষয়টি নিশ্চিত করার এক চমৎকার উপায়। কিন্তু রিস মনে করেন, আত্মচালিত আচরণ যথেষ্ট হওয়া উচিত।

আবার, কিছু প্রাণী পরীক্ষায় তাদের শরীরে চিহ্নের বিষয়ে হয়তো আগ্রহই প্রকাশ করতে না পারে। প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণীর তুলনায় হাতি সম্ভবত পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কম আগ্রহী। কখনো কখনো তারা মাটিতে গড়াগড়ি করে এবং সাধারণভাবে তাদের শুড় পরিস্কার করে না।

সুতরাং, কখনো যদি কোনো হাতি তার মাথায় অপরিচিত একটি দাগ দেখতে পায়, সে এটিকে তুচ্ছ বিবেচনা করবে এবং এ নিয়ে অতিরিক্ত কোনো আগ্রহ দেখাবে না।

অপরদিকে গ্যালপ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পরিস্কারভাবে পরীক্ষণ ছাড়া, গবেষকরা আয়নায় প্রাণীর আচরণ সম্পর্কে ভিডিওচিত্র ধারণ করে যাই দেখতে চাইবেন, তা দেখাই তার জন্য সহজ হবে। তিনি বলেন, ‘ভিডিওটেপের এ সমস্যা শুধু ডলফিন নয় বরং আয়নার সামনে নিয়ে অন্য প্রাণীদের বিষয়েও একই সমস্যা রয়েছে। এই ভিডিওটেপগুলো অনেকটা রোরস্কেচ পরীক্ষা মতো।’

তিনি বিশ্বাস করেন তার চিহ্নিত করার পরীক্ষাটি প্রাণীদের আত্ম-সচেতনতার শক্তিশালী প্রমাণ, যাতে পরীক্ষণের উপাদান প্রাণী নিজের প্রতিই মনোযোগী হয়। তিনি বলেন, আত্ম-সচেতনতা একটি বিবর্তনের ধাপ, যা শুধু মানুষ ও তার কাছাকাছি আত্মীয়দের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। যা পরে তাদের সহানুভূতি ও উচ্চতর চিন্তার সক্ষমতার দিকে চালিত করেছে।

গ্যালপ বলেন, ‘যখনই আপনি আয়নায় নিজেকে চিনতে শিখবেন এবং আপনার নিজের অভিজ্ঞতার উপাদানে পরিণত হবে, আপনি তখন অন্যান্য প্রাণীর অভিজ্ঞতার তুলনায় নিজের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহারের সিদ্ধান্তের অবস্থানে, কমপক্ষে নীতিগত অবস্থানে পৌঁছাতে পারবেন।’

কিন্তু পভেনলি, যিনি একসময় গ্যালপের আয়নার এই পরীক্ষণের বিষয়ে আকর্ষিত ছিলেন এবং যা তাকে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই প্রাণীদের জ্ঞানগত অবস্থার গবেষণায় কাটাতে উদ্বুদ্ধ করে, বলেন, পরীক্ষাগারের একটি পরীক্ষার জন্য এর ধারণা বিপুল।

তিনি বিশ্বাস করেন, আয়নার পরীক্ষা শিম্পাঞ্জির মধ্যে আত্ম-সচেতনার কিছু উপাদানকে প্রকাশ করেছে। কিন্তু এতে পুরো মনোজগত প্রকাশিত হয়নি। হয়তো তাদের মধ্যে নিজেদের শরীরের গতিবিধি সম্পর্কে অভিজ্ঞতামূলক ধারণা ও আয়নার গতিবিধিতে তার প্রতিবিম্ব কাজ করে।

শারীরিক আত্ম-ধারণার সাথে, শিম্পাঞ্জি আয়নাকে তার শরীর পরীক্ষা বা পরিস্কারের জন্য সহায়ক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তা প্রাণীদের মনোজগতের সমৃদ্ধি সম্পর্কে বিশেষ কিছুই নির্দেশ করে না।

পভিনেলি প্রশ্ন করেন, ‘আয়নার এই পরীক্ষার প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, যখন একটি শিম্পাঞ্জি তার আয়নার প্রতিবিম্বের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন সে কী চিন্তা করে?’
সর্বোপরি, মানুষের বিভিন্ন জটিলতর চিন্তার উদ্ভব হয় যখন তারা আয়নার সামনে দাঁত মাজে বা শেভ করে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এটিই কি অপরিহার্য? আমাকে কি আয়নার সামনে দাঁত মাজার সময় তাই চিন্তা করতে হবে?’

এবং শিম্পাঞ্জি ছাড়া অন্য বানর প্রজাতির ক্ষেত্রে সত্য, তারা আয়নার সামনে বছরের পর বছর তাদের নিজেদের প্রতিবিম্ব শনাক্ত করার কোনো চিহ্ন ছাড়াই কাটিয়ে দেয়। সাম্প্রতিককালে গবেষকরা দেখান, যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তারাও এই বিষয় অনুশীলন করতে পারে।

তিনি বলেন, মানুষ বিড়াল, কুকুর ও অন্য প্রাণীদের সাথে বহুকাল থেকে জীবন পার করে আসছে এবং সাধারণভাবে নিজেদের উপলব্ধিই তাদের ওপর চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমরা তাদের সরাসরি সাক্ষাতকার নিতে পারি না।

পভিনেলি বলেন, ‘যখন বিজ্ঞানের আবরণে আয়না ও চিহ্নের মতো এমন একটি পরীক্ষা আসলো এবং আমরা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগার পেলাম। আমরা তাৎক্ষণিকভবেই নিশ্চয়তার ওই পর্যায়ে চলে আসলাম যা আমাদের চিন্তায় ছিলো।’

সূত্র : এনপিআর

Scroll to Top