বাংলার আয়না

পরিকল্পিত জনপদের দৃষ্টান্ত চরফ্যাশন

৯০ বছর আগে বাংলাদেশে ব্রিটিশদের গড়া নগর/পরিকল্পিত জনপদের দৃষ্টান্ত চরফ্যাশন

শাহেদ মুহাম্মদ আলী
ভারতের চণ্ডীগড়, যুক্তরাজ্যের মিল্টন কিনস, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া—এগুলো পরিকল্পিত আধুনিক শহরের নাম। শুধু নাগরিক বা পর্যটকদের কাছেই নয়, এ শহরগুলো বিশ্বের নগর পরিকল্পকদের কাছেও উদাহরণ। কম জমি আর বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশে এ রকম একটা শহর গড়ে তোলা কি সম্ভব?

শুধু শহর নয়, বাংলাদেশে প্রায় পুরো একটি উপজেলাই আছে নিখুঁত পরিকল্পনার আওতায়। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত সেই পরিকল্পনা।

প্রায় ৯০ বছর আগে ব্রিটিশরা তা করে গেছে। এলাকাটি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা। পরিকল্পনার ধরন বলছে, ব্রিটিশরা সেই আমলেই এই অঞ্চলে একটি পরিকল্পিত জনপদ গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

চরফ্যাশন উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকাই আয়তাকারে বিন্যস্ত। মানে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত নগর পরিকল্পনার আদলে চৌকো করে (ব্লকে ভাগ করা) সাজানো। প্রতিটি ব্লকের চারপাশে ১৬ ফুট চওড়া রাস্তা। ব্লকের চার কোনায় চারটি চৌরাস্তা। যেকোনো দিক দিয়ে এসব ব্লকের ভেতরে চলাচল করা যায়। একটি থেকে আরেক চৌরাস্তার দূরত্ব আনুমানিক ২০০০ ফুট। মানে ২০০০ ফুট পর পর মিলবে একেকটি চৌরাস্তা।

চরফ্যাশনের এসব তথ্য মেলে ধরা হলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়—বুয়েটের নগর পরিকল্পনা বিভাগের (ইউআরপি) প্রধান মো. মোসলেহ উদ্দিন হাসান, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক এবং বেঙ্গল ইনস্টিটিউট : আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস, সেটলমেন্টের মহাপরিচালক স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফের সামনে। তথ্যগুলো জেনে অকপট বিস্ময়ে তাঁরা বলেছেন, এমনটা হয়ে থাকলে বাংলাদেশের জন্য তা বড় আশীর্বাদ।

বুয়েটের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. মোসলেহ উদ্দিন হাসান বললেন, এই পরিকল্পিত জনপদ সম্পর্কে তাঁদের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। পরিকল্পিত শহর হিসেবে শিক্ষার্থীদের তাঁরা পড়ান ভারতের চণ্ডীগড়, পুদুচেরী বা জয়পুর, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়া ইত্যাদি নগরের ইতিহাস। সেসব শহরের পরিকল্পনার ইতিহাস, ধরন পড়ে দীক্ষিত হন শিক্ষার্থীরা।

প্রাথমিক খোঁজখবর নিয়ে স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফ এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘অনন্য এই তথ্য আমাদের সামনে হাজির করার জন্য ধন্যবাদ। এটি শুধু একটি নগরের নয়, বরং পুরো একটা অঞ্চলের পরিকল্পনা। আমার ধারণা, অঞ্চল পরিকল্পনায় চরফ্যাশনের এই বৈশিষ্ট্য দারুণ এক মাইলফলক হয়ে উঠবে। ’

এই পর্যায়ে ঘুরে আসা যাক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলা থেকে। ভোলা থেকে আঞ্চলিক সড়ক ধরে বাস থামবে উপজেলা শহরের মুখে। ছোট্ট শহরের প্রধান সড়কটি যথেষ্ট চওড়া। সেই সদর রাস্তা থেকে দুই দিকে প্রায় সমান দূরত্বে সোজা রাস্তা ঢুকে পড়েছে শহরের ভেতরে। শহর ছাড়িয়ে একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে তা প্রবেশ করেছে গ্রামে।

একটা রিকশা নিন। ‘সোজা যাওয়া যাবে না, রাস্তা একটু খারাপ। এ পাশ দিয়ে যাই’—বলতে বলতে রিকশাচালক নিজের মতো করে চলতে থাকবেন। এই শহরে আসলেই পর্যাপ্ত রাস্তা। রাস্তাগুলো তীরের মতোই সোজা।

হাতে স্মার্টফোন থাকলে গুগল ম্যাপ বের করুন। চরফ্যাশন ভোলার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা। পূর্বে মেঘনা নদী। পশ্চিমে তেঁতুলিয়া। আর দক্ষিণ-পশ্চিমে বুড়া গৌরাঙ্গ নদী। উত্তরে লালমোহন উপজেলা। আর দক্ষিণে অবারিত জলরাশির বঙ্গোপসাগর। মানচিত্রে উপজেলার ঠিক নিচে আছে চর কুকরিমুকরি, ঢালচর, নতুন ঢালচর।

আরো জানতে কৌতূহল হচ্ছে? চলুন চরফ্যাশন সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কাওছার আহমেদের কাছে। ইতিহাসে উৎসাহী স্থানীয় বাসিন্দা। জানালেন, চরফ্যাশনের ৮০ শতাংশ এলাকাই পরিকল্পিত। পুরো উপজেলা ব্লকে ভাগ করা। ব্যতিক্রম শুধু আমিনাবাদ ইউনিয়নটি। এই এলাকাটি পরিকল্পনার বাইরে রয়ে গেছে।

এই অজপাড়ায় এমন নিখুঁত পরিকল্পনা কে বাস্তবায়ন করলেন? ইতিহাসের সোঁদা গন্ধময় বই খুঁজতে হবে না, কাওছার আহমেদের মতো কেউ কেউ জানেন এর জবাব। এর পরিকল্পক তৎকালীন চরফ্যাশনের সার্কেল কর্মকর্তা ব্রজগোপাল সেন। আর এই তৎকালটা হলো ব্রিটিশ আমল। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ব্রজগোপাল সেন চরফ্যাশনে কর্মরত ছিলেন। ধারণা করা হয়, ১৯৩০ সালের পর তিনি এলাকার ভূমি বিন্যাস, রাস্তাঘাট, নগর পত্তনের কাজ শুরু করেন।

১৮৮৫ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত তখনকার বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট ছিলেন জে এইচ ফ্যাশন। তাঁর নামেই এই দ্বীপ উপজেলার নাম চরফ্যাশন। উপজেলা তথ্য বাতায়নে এর আয়তন লেখা আছে প্রায় এক হাজার ৪৪০ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে এককভাবে দেশের ১৮টি জেলাও চরফ্যাশনের চেয়ে ছোট, এখানকার মানুষ গর্ব করে বলে।

তা, বিচ্ছিন্ন চর না হয়েও আমিনাবাদ ইউনিয়ন কেন পরিকল্পনার বাইরে? নিজেও ওই এলাকার বাসিন্দা অধ্যক্ষ কাওছার আহমেদই দিলেন তার জবাব। জানালেন, ১৯০৮ সালে ভোলার উত্তরের (শাহবাজপুর) কুচিয়ামারার লোকজন ফরিদপুরের উপষির জমিদার কালীপ্রসন্ন ভট্টাচার্য চৌধুরীর কাছ থেকে ৯ মণ কাঁচা টাকায় (প্রতি কেজিতে ৮০টি মুদ্রা) আমিনাবাদ ইউনিয়নের একটি অংশ কিনে নেয় বসবাসের জন্য। এ কারণে ব্রিটিশ সরকারের বন্দোবস্তের বাইরে থাকায় ওই ভূমিটুকু ব্রিটিশদের পরিকল্পনার বাইরে থেকে যায়।

এখন এখানকার জমি দামি হলেও তখনকার দিনে এখানে কেউ জমি বন্দোবস্ত নিতে চাইত না। জমি নিলে ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা দিতে হবে, এই ভয়ে খাসমহল কর্মকর্তা ব্রজগোপাল সেনের সামনে দিয়ে কেউ হাঁটত না বলে জনশ্রুতি আছে।

তাহলে এই চরে লোকবসতি হলো কী করে? ভোলা জেলার ইতিহাস বইয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী লিখেছেন, তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষিত, অভিজাত মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮টি পরিবারকে জমি দিয়ে এখানে বসবাসের জন্য নিয়ে আসেন ব্রজগোপাল সেন। ৯টি পরিবার ছিল মুসলমান আর ৯টি ছিল হিন্দু পরিবার। ‘ভদ্র সমাজের’ এই বাসস্থানের নামও ছিল ভদ্রপাড়া। নামটা এখনো টিকে আছে। প্রতিটি ‘ভদ্র’ পরিবারকে ২০ কানি (৩২ একর) ফসলি জমি ও ১৬ গণ্ডার (১২৮ শতক) একটি বাড়ি দেওয়া হয়। প্রতিটি বাড়িতে ছিল দুটি পুকুর। একটি মাছ চাষসহ পারিবারিক ব্যবহারের জন্য, অন্যটি ছিল সুপেয় পানির আধার। পুকুরের চারপাশে লাগানো হয় ফলদ গাছ। টিনের বসত ও কাচারি ঘরও করে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

বসতি গড়া পরিবারগুলোর নানাবিধ কাজকর্মে সহায়তার জন্যে আনা হয় ৯টি উখরাইত পরিবারকে। ভদ্রপাড়ার পশ্চিম পাশে উখরাইত পাড়াটি এখনো আছে। এ পাড়ার প্রতি পরিবারকে সাড়ে তিন কানি (সাড়ে পাঁচ একর) কৃষিজমি, একটি বাড়ি, একটি ঘর, একটি পুকুর করে দেওয়া হয়।

স্থানীয় সাংবাদিক নেয়ামত উল্লাহকে সঙ্গী করে গেলাম ভদ্রপাড়ার মকবুল আহমেদের (বিটি সাহেব) বাড়িতে। প্রয়াত এই শিক্ষকের নাতি আক্তারুল আলম ওরফে শামু চরফ্যাশন পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তাঁদের বাড়ির প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন টিনের ঘরটি বেশ কয়েক দফা সংস্কারের কারণে এখনো টিকে আছে। পুকুর অক্ষত আছে একটি।

আক্তারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি বাবার কাছে শুনেছেন তাঁর দাদা ভোলার ধনিয়া ইউনিয়ন থেকে চরফ্যাশন ভদ্রপাড়ায় আসেন। শুরুতে কেমন ছিল এই ভদ্রবাড়ি তা দাদির কাছে শুনেছেন। মূলত আক্তারুল আলমের বাড়ির বর্তমান অবস্থা এবং তাঁর দাদির মুখে শোনা তথ্যের ভিত্তিতেই আঁকা হয়েছে (প্রথম পাতায়) বিটি সাহেবের বাড়ি।

চরফ্যাশনে ভদ্রদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল চরফ্যাশন মিউচুয়াল বেনিফিট হাউস বিল্ডিং কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড। বলা হয়, এটি এ অঞ্চলের প্রথম নিবন্ধিত সমবায়। ওই কো-অপারেটিভের সদস্য ছিলেন সেই ১৮ পরিবারের প্রধানরা। এখনো টিকে থাকা সংগঠনটির বর্তমান সম্পাদক মীর মো. শরীফ। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, বনায়ন ও শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেন। ’

এখানকার মানুষ ব্রজগোপাল সেনকে নিছক তাঁদের স্মৃতি বা ইতিহাসের পাতাতেই রেখে দেননি। ব্রজগোপাল টাউন হল, ব্রজগোপাল ক্লাব—এসব নামে তিনি শহরটিতে জীবন্ত হয়ে আছেন।

বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বললেন, ‘আমি অভিভূত। এত বছর আগে একটা প্রত্যন্ত এলাকায় পরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং এখনো তা অক্ষত আছে, এটা দারুণ খবর। এ দেশে যে অবকাঠামোর দিক থেকে এমন একটা জায়গা আছে, সেটা আমাদের জন্য বিরাট আশীর্বাদ। ’
সংশয় সৃষ্টি হয়েছে, এখানকার ১৬ ফুট চওড়া রাস্তা শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না। স্থানীয় পৌরসভা রাস্তার দুই পাশে পাকা নর্দমা তৈরি করছে। এতে রাস্তা সরু হয়ে যাচ্ছে। আবার ব্লকগুলোর ভেতরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে জায়গা ছাড়া না-ছাড়ার বিষয়গুলো এখনই শঙ্কা তৈরি করছে।

এই উদ্বেগ জানালে চরফ্যাশন পৌরসভার প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম জানালেন, তাঁরা কাজ করেন উন্নয়ন প্রকল্প অনুযায়ী। ১২ থেকে ১৪ ফুট রেখে যেসব রাস্তায় সম্ভব সেখানে তাঁরা পাকা ড্রেন ও ফুটপাত তৈরি করছেন। বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও তাঁরা অন্য পৌরসভার মতো সামনে পাঁচ ফুট, পেছনে আড়াই ফুট জায়গা ছাড়ার নিয়ম অনুসরণ করতে বলেন নগরবাসীকে।

অঞ্চল পরিকল্পনা হিসেবে চরফ্যাশনের সঙ্গে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গ্রিড পরিকল্পনার মিল দেখেন স্থপতি কাজী খালিদ আশরাফ। ভারতেও এমনটি নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘একটা অঞ্চলকে অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে আনার এ এক অভিনব পরিকল্পনা। উপকূলীয় এলাকায় এমন অঞ্চল পরিকল্পনার নজির আমি দেখিনি। ’

বড়-ছোট অনেক শহর রেখে চরফ্যাশনের মতো দ্বীপে এমন একটি পরিকল্পিত অবকাঠামো গড়ে তোলার পেছনে কারণ কী? খালিদ আশরাফ মনে করেন, ‘এর বিস্তারিত জানতে আমাদের অনুসন্ধানে নামতে হবে। গবেষণা করতে হবে। (সংকলিত।

Scroll to Top