বাংলার আয়না

২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২২ শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

Ad

আলোচনায় বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা

গ্রন্থের নাম- বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা
ধরণ- কাব্যগ্রন্থ
কবি- মাহমুদা বেগম সিমু
প্রচ্ছদ- রত্নেশ্বর সূত্রধর
মূল্য- ১৫০ টাকা
প্রকাশনা- প্রিয়জন সাহিত্য প্রকাশনী

“বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা” কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে কিছু কথা ও অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে শুরুতেই কবি হেলাল হাফিজের হৃদয়স্পর্শী কয়েকটি চরণ মনে পড়ে গেলো—
“কবির জীবন খেয়ে জীবনধারণ করে কবিতা এমন পিতৃঘাতী শব্দের শরীর, কবি তবু সযত্নে কবিতাকে লালন করেন, যেমন যত্নে রাখে তীর জেনে-শুনে সব জল ভয়াল নদীর।
— হেলাল হাফিজ

কবিতা নিয়ে কবি হুমায়ুন আজাদ চমৎকার একটি মন্তব্য করেছিলেন–
” মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে, কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।”– হুমায়ুন আজাদ

কবিতা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে, চিন্তার বাগানে সৌরভ ছড়ায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়, সুন্দর পথের সন্ধান দেয়।
কবিতা মা, মাটি ও মানুষের কথা বলে, ভাষা ও স্বাধীনতার কথা বলে , প্রেম-বিরহের কথা বলে,
কবিতা অজ্ঞতার বুকে আলো জ্বেলে দেয়। এ প্রসঙ্গে সেক্সপিয়ারের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়–
” Ignorance is the curse of God;
knowledge is the wing wherewith we fly to heaven.”– Shakespeare

কবি, গল্পকার ও শিক্ষিকা মাহমুদ বেগম সিমুর লেখা ” বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা” কাব্যগ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া প্রতিটি কবিতার মধ্যে যেন এক ভিন্নরকম ইলুশান সৃষ্টি হয়েছে যা পাঠ করতে গিয়ে বারবার এক অন্যরকম মায়ায় আবিষ্ট হয়ে পড়ি। প্রেম-মায়া-দ্রোহ, যুদ্ধ, পিতৃপ্রেম, স্বাধীনতার গৌরব, অনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে, মহামারী করোনায় বিষাদঘেরা ধরনীর নিঃশেষ প্রাণের হাহাকারে আবেগী শব্দ বুননে সেজে উঠেছে অসংখ্য কবিতার শরীর। যে মহান ব্যক্তির হাত ধরে হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম অর্জন হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তিনি লিখেছেন স্বাধীনতার স্থপতি সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। “বঙ্গবন্ধু” নামক শিরোনামের এই কবিতায় কবি বলছেন–

“হে বঙ্গবন্ধু তুমি বজ্রকণ্ঠে বলেছিলে,
অধিকার আদায়ের কথা।
নির্মূল করেছিলে পাকিদের কুচিন্তার নীল নকশা।
অন্যায়ের কাছে তুমি কখনো করোনি মাথা নত,
তুমি নির্ভীক হয়ে তোমার সোনার বাংলা গড়েছো।”

কবিতার উপরোক্ত চরণগুলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জাতির জনকের প্রতি তার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধের কথা।

দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া লোনাজল দিয়ে কবি স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রয়াত বাবার বীরত্বের কথা লিখেছেন। জেলজীবনে তার উপরে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন ” সুপ্ত এক দেশ প্রেমিকের কথা” নামক কবিতায়। এখানে কবি বলছেন–

“ওহ কী যন্ত্রণা দিয়েছে নির্মম পাষণ্ডরা !
মাথায় আঘাতের পর আঘাত করেছে, রক্তাক্ত করেছে,
সিগারেট জ্বালিয়ে শরীর পুড়িয়ে দাগ করে আনন্দে মেতেছে।
প্রায়ই সে যন্ত্রণার ব্যথা ৪০ বছর পরেও অনুভব করছে,
আর নীরবে চোখ মুছেছে।”

বাবা-মা হারা এই কবি যেন আজো তার বাবার ডাক শুনতে পায়, এখনো যেন বাবার সেই কষ্টগুলো তাকে নীরব যন্ত্রণা দেয়।
কবিতাগুলোতে ভাষার সহজ সরল ব্যবহার যেন পুরো বিষয়গুলো যেন আরো হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। মায়ের স্নেহমাখা স্মৃতিগুলো যেন আজও কবির দুচোখে অশ্রু ঝরায়, বিরহ-বেদনায় বুকের জমিন সিক্ত হয়ে ওঠে। “মায়ের স্মৃতি” কবিতায় কবি বলছেন—
” মাগো কেমন আছো তুমি? খুব জানতে ইচ্ছে করে,
তোমার ফেলে আসা স্মৃতিগুলো বড্ড মনে পড়ে!
প্রতিদিন খুঁজি তোমার মিষ্টি হাসি ওই সোনালি ভোরে।”
সত্যি এই পৃথিবীতে মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আদরমাখা স্মৃতি প্রকৃত সন্তান কখনো ভুলতে পারে না।
কবি মাহমুদা বেগম সিমু সময়ের ন্যায্য চাওয়াকে ধারণ করেছেন বুকে, অনৈতিক হত্যাকাণ্ডে তার কলম সোচ্চার হয়ে উঠেছে বারবার। তিনি “বিচার চাই” কবিতায় বলছেন–
” হে তনন তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
তোমার জন্য কতো কলম আজ জাগ্রত?
কতো গান, কতো কবিতা তোমায় নিয়ে হচ্ছে রচনা?
তুমি জেনে নিও তুমি না থাকলেও তুমিই করে গেলে,
প্রতিবাদের নতুন কোনো অধ্যায়ের সূচনা।”

কবি চায় না এই পৃথিবীতে কেউ এমনভাবে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক। বিচার বহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ডই এই পৃথিবীতে কাম্য নয়। কাম্য নয় কোনো কবির জীবন এইভাবে নিঃশেষ হোক। তাইতো কবির কলম প্রতিবাদ করে ওঠে বিচারের দাবিতে। এমন অনেক দ্রোহের কবিতাও স্থান পেয়েছে ” বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা” কাব্যগ্রন্থটিতে। লিখেছেন এই প্যান্ডামিক সময়ের বুকে বসে করোনার ভয়াবহতা। “আবার জাগবে সারা বিশ্ব” কবিতায় কবি বলছেন—
” কি করুণ আর্তনাদ আর অসহায়ত্বের অপলক দৃষ্টি!
কারো সাথে নেই আগের মতো সম্পর্ক প্রীতি।
আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কেউ আপন নয়,
ভালোবাসা আটকে গেছে ভাইরাস করোনায়।
প্রতিদিন যাদের কর্মের প্রতি ছিলো ভীষণ তাড়া,
তাদেরই কর্ম নাই, অন্ন নাই, শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা।”

করোনা শুধু মানুষের জীবনই কেড়ে নেয়নি, মানুষের ভালোবাসায় একরকম দূরত্বও সৃষ্টি করেছে, নিরুপায় হয়ে একসময় মানুষ গৃহবন্দি হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছিলো। সেই সময়ের করুণ চিত্রটুকুও কবি কবিতায় ধারণ করেছেন। কবি আশাবাদী এই পৃথিবী আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে, কেটে যাবে সব জরাজীর্ণতা। এরকম আরো কিছু কবিতার শব্দে সেজে উঠেছে এই কাব্যগ্রন্থটি। প্রেমের কবিতাগুলো যেন এই কাব্যগ্রন্থের কাননে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ছে এদিক-ওদিক। “সব ভুলে যেও তুমি” কবিতায় কবি বলছেন—
আমি জানি তুমি অনেক সুখে আছো
সব ভুলে গেছো পুরনো যা কিছু ছিলো।
তবুও, তবুও
যদি মন কাঁদে আমার বিরহ তবে সব ভুলে যেও তুমি।”
এরকম অনেক হৃদয়স্পর্শী কবিতা রয়েছে এই গ্রন্থটিতে।

কবি মাহমুদা বেগম সিমুর ” বাবা, যুদ্ধ এবং ভালোবাসা” কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ নামকরণের সাথে দারুণ অর্থবহ হয়েছে। ভালো কভারে সজ্জিত বইটির ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোও বেশ উন্নত। গ্রন্থটি পাঠক হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছে ইতোমধ্যে। গ্রন্থটি আরো পাঠকপ্রিয়তা পাক সে প্রত্যাশা করছি।

আলোচক: মোহাম্মদ খায়রুল আলম, প্রতিষ্ঠাতা, এপেক্স ক্লাব অব রেনেসাঁ। প্রতিষ্ঠাতা, রেইনবো নারী ও শিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশন।

Scroll to Top