বাংলার আয়না

২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২২ শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

Ad

কেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি?

গ্রন্থালোচনা
গ্রন্থের নাম- কেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি?
ধরণ- প্রবন্ধ
লেখক- জহিরুল হক বিদ্যুৎ
প্রচ্ছদ- চারু শিল্প
মুল্য- ৩০০ টাকা
প্রকাশনী- প্রিয়জন সাহিত্য প্রকাশনী

কেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি? গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনার শুরুতেই এর বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু কথার ভূমিকা টানছি। পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষের কাছে তার মায়ের ভাষা প্রাণাধিক প্রিয়, সন্তান যেমন প্রিয় তার মায়ের কাছে, তার বাবার কাছে। আর এই প্রিয়তাকে কেন্দ্র করে একটি জাতি তখনই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় যখন তারা মাতৃভাষাকে হৃদয়ে লালন, ধারণ ও বৈরিচিন্তার নাগপাশ থেকে একে রক্ষা করে, শিশ্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে উন্নত চিন্তার প্রতিফলন ঘটায় আর জাতির মুক্তি এনে দেয় অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি উক্তি করেছিলেন- আমাদের মধ্যে যাহা কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা কিছু অমর করিবে সেই সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার– প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজকে আমরা যে বাংলাভাষায় কথা বলি এর রূপরেখা আজ থেকে হাজার বছর আগে এমনটি ছিলো না। ভাষা গবেষকদের মতে খৃষ্টপূর্ব সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এরপর হাজার হাজার বছর ধরে আর্য, সংস্কৃতি ও অপভ্রংশ রূপে বিবর্তন হয়ে বাংলাভাষা আজ নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাষাবংশ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইউরোপে, এশিয়ার ইরান ও ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। পৃথিবীর প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ বাংলাভাষায় কথা বলে। তৎকালীন সময়ে এই পূর্ববাংলা বর্তমান বাংলাদেশেও এই বাংলাভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তৎকালীন সরকার উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল এই দেশে। তারপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত মাতৃভাষা রক্ষার্থে সৃষ্টি হয় এক রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৯৫২ সালে সেই ভাষা আন্দোলনের রক্তের পবিত্র প্রবাহে জন্ম নেয় একে একে ৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই পূর্ববাংলায় বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় উন্নতি করা এবং বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে যে কতো ত্যাগ, কতো রক্ত ঝরাতে হয়েছে তা ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়। এই প্রসঙ্গে নেপোলিয়ন বেনাপার্ট একটি উক্তি করেছিলেন- . তার মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা একজন সভ্য মানুষের প্রথম মর্যাদা।
— নেপোলিয়ন বেনাপোর্টে।

এই বাংলাভাষা, বাঙালি জাতিসত্ত্বা, অসহায় ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে ও মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এই ভারতীয় উপমহাদেশ সহ আরো কিছু কিছু স্থানে শত-সহস্র বছর ধরে কবি-সাহিত্যিকগণ, রাজনৈতিক নেতা, ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ছাত্র-জনতা সহ অনেক বাঙালি আমৃত্যু যুদ্ধ করেছেন তাদের ভুলবার নয় আমরা ভুলিনি।

এই সময়ের আলোচিত কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও বাচিকশিল্পী জহিরুল হক বিদ্যুতের লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধ ” কেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি? এর শিরোনাম সহ নিখুঁত তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ বিষয়বস্তু সম্বলিত গ্রন্থটি পড়ে আমি ভীষণ অবাক হয়েছি। এই পূর্ব বাংলায় সর্বস্তরে বাংলাভাষার অধিকার রক্ষার গোড়াপত্তন, ভাষা আন্দোলনের নেপথ্য ভূমিকা আর স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তিনি যেভাবে নিখুঁত তথ্য দিয়ে, যুক্তি দিয়ে শিরোনামের যথার্থতার সাথে মূল্যায়ন করেছেন তা সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করেছে। পাশাপাশি প্রাবন্ধিক জহিরুল হক বিদ্যুৎ ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে উঠে আসা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির সৃষ্টি, কর্ম, ত্যাগ, সাধনা, দর্শন বিভিন্ন বিশ্বস্ত তথ্যের সাহায্যে এতো চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন যার নির্যাস পান করে আমার মনে হয়েছে এই গ্রন্থটি পাঠক হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়া দেবে এবং এই ২০ জন বাঙালির জীবনাদর্শ পড়ে বুঝতে সুবিধা হবে কেন বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকায় শীর্ষে।

এই বিষয়ের পক্ষে যুক্তি অঙ্কন করতে গিয়ে লেখক এখানে ২০০৪ সালের বিবিসি জরিপ, গোয়েন্দা তথ্য, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, বিভিন্ন গুণীজন ও মনিষীর উক্তি, জেলখানার রোজনামচা, বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকে নেয়া সত্য ও গ্রহনযোগ্য তথ্য ব্যবহার করেছেন। আমি বলবো এই ক্ষেত্রে জহিরুল হক বিদ্যুৎ দারুণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি ” কেন তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি?” এই গবেষণামূলক প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের আরেকটি মাইলফলক হয়ে থাকবে আর সৃষ্টির মূল্যায়নে পাঠক হৃদয়ে বেঁচে থাকবে যুগযুগ। আমার জানামতে এই গ্রন্থটি অনেক কবি, সাহিত্যপ্রেমী পাঠকগণ ইতোমধ্যেই সংগ্রহ করেছেন। আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করছি গ্রন্থটি পৌঁছে যাক পৃথিবীর সকলপ্রান্তে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষিদের হাতে। মুদ্রণ, কাগজের মান, কভার , প্রচ্ছদও বেশ উন্নত মানের ও চিত্তাকর্ষক। সময়ের এই আলোচিত লেখকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
আলোচক: মোহাম্মদ খায়রুল আলম, প্রতিষ্ঠাতা, এপেক্স ক্লাব অব রেনেসাঁ। প্রতিষ্ঠাতা, রেইনবো নারী ও শিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশন

Scroll to Top