বাংলার আয়না

২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৯ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২২ শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

Ad

একজন সাংবাদিকের চোখে বেনজিন ভূট্টো হত্যা এবং আজকের পাকিস্তান

২০০৭ সালে ডিসেম্বরে একটি প্রচার সমাবেশ থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভূট্টোকে রাওয়ালপিন্ডিতে আত্মঘাতি বোমা হামলার মাধ্যমে হত্যা করে ১৫ বছরের এক বালক। বেনজির ভূট্টোর হত্যা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক বিশৃংখলা ওয়াশিংটনের দরজায় প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সাথে মার্কিন মিত্রতা থাকা সত্বেও পারমাণমিক শক্তিধর পাকিস্তান যে সোজাসুজি পতনের মধ্যে ছিল, এই ঘটনা ছিল তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত।

সেই পতনের সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে এনপিআরের সদর দফতরে একজন রিপোর্টার হিসেবে আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু। ভুট্টো হত্যার দিন পাকিস্তানের শহরগুলো যখন বিশৃঙ্খলায় ডুবে যায় তখন আমাকে আমার জন্মভূমির ফোন লাইনে কাজ করতে বলা হয়। কিছু দিনের মধ্যে পরবর্তী কভারেজের কাজে আমি স্বল্প সময়ের জন্য ইসলামাবাদগামী একটি বিমানে ছিলাম। একজন পাকিস্তানি আমেরিকান হিসাবে আমি ভাষা এবং সংস্কৃতি জেনে থাকতে পারি, তবে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অমূল্য গবেষণার জন্য আমি আইরিশ সাংবাদিক ডেক্লান ওয়ালশের ক্লিপিংস (পত্রিকার কেটে রাখা অংশ) বহন করেছি। তারপর গার্ডিয়ানের আঞ্চলিক সংবাদদাতা হিসাবে লিখছিলাম।

সেই সময়টির দিকে ফিরে তাকাতে এখন আশ্চর্য্য লাগে যে একসময় যে পাকিস্তান ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ কেন্দ্রবিন্দু ছিল, সেটি আন্তর্জাতিক শিরোনাম থেকে কীভাবে হারিয়ে গেলো এবং নিশ্চিতভাবে আমার নিজস্ব সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার থেকেও। ওয়ালশ তার ‘দ্য নাইন লাইভস অফ পাকিস্তান : ডিসপ্যাচস ফ্রম অফ প্রিরিয়াস স্টেট’ বইতে ঝামেলায় জর্জরিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রটির অতীতে ফিরে গিয়েছিলেন এবং নাইন ইলেভেনের পরের বছরগুলোতে পাকিস্তানের অবস্থা বর্ণনার জন্য তার রিপোর্টার নোটবুকটির ফিরিস্তি বর্ণনা করেছেন। ওয়ালশ প্রথমে গার্ডিয়ান এবং পরে নিউইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তান প্রতিনিধি ছিলেন। তার ভাষায় এই পত্রিকাগুলোতে তিনি পাকিস্তানের ‘বহুবিধ সংঘাতের সার্কাস’ নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন। এই পত্রিকাগুলোতে ওসামা বিন লাদেনের বাহিনীর উপর অভিযান এবং দেশটির সীমান্তজুড়ে অবিরাম যুদ্ধ সহ প্রতিটি বড় গল্পের লেখক ছিলেন তিনি।

বর্তমানে আফ্রিকায় টাইমসের প্রধান সংবাদদাতা ওয়ালশ তথ্যগুলো প্রেরণে অবদান রেখেছিলেন যেগুলো গুরুত্ব ও সহানুভূতির সাথে অনুরণিত হয়েছে। অল্প কথায় তিনি ইতিহাস এবং সংস্কৃতির স্তরগুলোকে উপস্থাপনার প্রাণবন্ত আল্পনায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। কিন্তু তার লেখাটি পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক উভয় পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় এটি দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগের ক্রোধের কারণ হয়েছিল। ফলে তার কাগজপত্র বাতিল করে ২০১৩ সালে তাকে বহিস্কার করা হয়। এই বহিষ্কার থেকেই নাইন লাইভের সূচনা, যেটিতে ওয়ালস জটিলতা কাটানোর চেষ্টা করতে করতে এক দশক কাটিয়ে দিয়েছেন এমন একটি দেশের প্রতিবিম্ব এঁকেছেন।

পরলোকগত ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক ক্রিস্টোফার হিচেনস একবার পাকিস্তানকে একটি ‘রসহীন, ভৌতিক ও অনিরাপদ’ জাতি হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। সালমান রুশদী এটিকে ‘সীমিতভাবে কল্পিত’ বলেছেন। তবে ওয়ালশ লিখেছেন, সেখানে তিনি বসবাস শুরু করার পর ‘আরো জটিল ও আকর্ষণীয় একটি দেশ নজরে আসল, যার কঠোর ভাবমূর্তির বাইরে মনোরম দিক রয়েছে, যেখানে মানুষ নিজেদেরকে আনন্দে ভাসিয়ে দিতে পছন্দ করে’।

ওয়ালশ একজন আকর্ষণীয় পথপ্রদর্শক হিসেবে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘পাক শব্দটি উর্দু যার অর্থ বিশুদ্ধ, সুতরাং আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তান অর্থ হল ‘বিশুদ্ধ দেশ’। কিন্তু তিনি আবিষ্কার করেছেন বাক্যাংশটি যেমনটি বুঝায় পাকিস্তানে মানুষের জীবন সবসময় তেমন বিশুদ্ধ থাকে না। তিনি একটি সংঘাতময় দেশ খুঁজে পেয়েছেন, খুঁজে পেয়েছেন একটি গভীর রক্ষণশীল সমাজ যেখানে ফেনারা বাসা-বেঁধে অবাধে প্রবাহিত হয়, যেমনটি স্কটরা আড়ম্বরপূর্ণ সান্ধ্যভোজনে করে থাকে। যেখানে কোকেন ধ্বনিতে ‘নাঁচের মেঝেতে মদ্যপ পুরুষের ঝাঁঝালো পাঞ্চ খেলা টেবিলগুলোর মাঝে বিচ্ছিন্ন পোশাকপরা নারীরা একাকার হয়ে থাকে’।

ওয়ালশের জন্য অবিরত খোলা দ্বারগুলো, কারণ পাকিস্তানের ড্রইং রুমগুলো অভিজাত এবং এটি রাজনৈতিকভাবে জড়িত, তাকে মশলাদার বিশ্লেষণ এবং শক্তিশালী শুচনাসহ খাবার সরবরাহ করে। ‘সিফারিশ ছিল সঠিক লোকেদের সাথে দেখা করার মূল চাবিকাঠি, এটি ছিল একজন সুপরিচিত বন্ধুর মধ্যস্থতা। পাকিস্তানে সিফারিশ ছিলেন এক ধরণের যাদুর কার্পেট। সঠিক চালনায় এই কার্পেট আপনাকে যে কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে – দূরবর্তী উপজাতি দুর্গগুলোতে, ওয়াজিরিস্তানের সেনা ঘাঁটি এবং শহরগুলোর গোপন কোণে নিয়ে যেতে পারে।’

একজন পাকিস্তানি পাঠক হিসাবে, আমি দেখেছি বইটির কিছু সাংস্কৃতিক সাধারণীকরণ এবং টিকা বহিরাগত কিছু বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছে। তবে দেশের সংঘাত সবসময় লেখকদের কল্পনা শক্তিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং এসব বিষয়ে ওয়ালশের দূর্দান্ত দৃষ্টিপাত রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সীমান্ত প্রদেশগুলো পরিদর্শনের একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রথম ওয়াজিরিস্তান দর্শন হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঠকঠক শব্দ করা একটি হেলিকপ্টারের গর্ত আকৃতির জানালা দিয়। চারিদেকে নয়নাভিরাম এক দৃশ্য ছড়িয়ে ছিল। দূর্গসদৃশ বাড়িগুলো মাথা ঘুরানো ঢালে আটকে ছিল। একটি শুকিয়ে যাওয়া নদীর ধার ঘেষে পোকামাকড়ের মতো একটি জিপ হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে। দানবাকৃতির সূর্য রশ্মিগুলো মেঘকে ছিন্নবিন্ন করছে।’

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ওয়ালশকে বহিষ্কার করায় যৌক্তকভাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতার দিকটি বের হয়ে আসে। আর তা হলো পাকিস্তানের সামরিক বিভাগ এবং বেসামরিক নেতৃত্বের মধ্যে যে বিভাজন তা বংশগত সামন্তবাদী শ্রেণীর কারণে উদ্ভব হয়েছে। ‘যদি মানচিত্রগুলো পাকিস্তানের বহিরাগত নিরাপত্তাহীনতাকে মনে করিয়ে দেয় তবে সত্য হলো, এর সর্বাধিক স্পর্শকাতর সীমানা দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত, যা জাতিগত, উপজাতি এবং সাম্প্রদায়িক ত্রুটিরেখা দ্বারা বিদীর্ণ। দেশের অভ্যন্তরেই মাথা ঘোরানো দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।’

রাজনৈতিক সংঘাত পাকিস্তানে একটি প্রতিহিংসায় বিভাজিত জনসমাজ তৈরি করেছে যা আজ অবধি টিকে আছে। ‘দেশের চেয়ে মতবাদ বেশি। ইতিহাস, পরিচয় এবং বিশ্বাসের কেন্দ্রীভূত শক্তির চাপে নিষ্পেষিত পাকিস্তান। একি কি টিকে থাকতে পারবে?’ প্রশ্ন ওয়ালশের। তার জোরপূর্বক প্রস্থানের ভিত্তিতে ওয়ালশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, গণতান্ত্রিক শক্তি নির্বিশেষে, ‘একটি কঠিন সত্যে ফুটে উঠেছে বলে মনে হয়েছিল যে সামরিক বাহিনী সর্বদা জয়ী হয়’।

সূত্র : ইনিডিপেন্ডেন্ট

Scroll to Top